লিখেছেন : ঘনশ্যাম মুখোপাধ্যায়
কথিত আছে – ১৩৯৬ খ্রীষ্টাব্দে ধ্রুবনন্দ ব্রহ্মচারী পুরী থেকে পায়ে হেঁটে শ্রীরামপুর মাহেশে এসে
জগন্নাথ দেবের রথের সূচনা করেন। পুরীর রীতি মেনে মাহেশ জগন্নাথ দেবের পুজো ও রথযাত্রা
অনুষ্ঠিত হয়। আগে এটি কাঠের রথ ছিল। শ্যামবাজারের বসু পরিবার ১৩৩ বছর আগে মার্টিন বার্ন কম্পানির লোহার রথ তৈরি করে। রথের উচ্চতা ৫০ ফিট, ৯টি চূড়া সজ্জিত, ১২টি চাকা বিশিষ্ট মাহেশের রথ পৃথিবীর মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম মাহেশের রথ। রথের সামনে দু’টি নীল-সাদা ঘোড়া রয়েছে। মোট ১২৫ টন ওজন। সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রাধারানি উপন্যাসে মাহেশের রথের উল্লেখ রয়েছে। মাহেশের রথ ঘিরে একমাস ধরে মেলা চলে স্নানপিঁড়ির মাঠে।
মাহেশের রথযাত্রা ভারতের দ্বিতীয় প্রাচীনতম এবং বাংলার প্রাচীনতম রথযাত্রা উৎসব।এই
উৎসব ১৩৯৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এটি পশ্চিমবঙ্গের শ্রীরামপুর শহরের মাহেশে হয়।
রথযাত্রার সময় মাহেশে এক মাস ধরে মেলা চলে। শ্রীরামপুরের মাহেশ জগন্নাথ দেবের মূল মন্দির
থেকে মাহেশেরই গুন্ডিচা মন্দির (মাসীরবাড়ী) অবধি জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার বিশাল রথটি টেনে
নিয়ে যাওয়া হয়। উল্টোরথের দিন আবার রথটিকে জগন্নাথ মন্দিরে ফিরিয়ে আনা হয়।
মাহেশের জগন্নাথ মন্দির ও রথযাত্রা উৎসবের পিছনে একটি কিংবদন্তি রয়েছে। সেটি হল:
চতুর্দশ শতকে ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী নামে এক বাঙালি সাধু পুরীতে তীর্থ করতে গিয়েছিলেন। তাঁর ইচ্ছা
হয়েছিল যে তিনি জগন্নাথদেবকে নিজের হাতে ভোগ রেঁধে খাওয়াবেন। কিন্তু পুরীর মন্দিরের পাণ্ডারা বাধ সাধায় তিনি তা করতে পারলেন না। তখন দুঃখিত হয়ে তিনি আমরণ অনশনে বসলেন। তিন দিন পরে জগন্নাথদেব তাঁকে দেখা দিয়ে বললেন, "ধ্রুবানন্দ, বঙ্গদেশে ফিরে যাও। সেখানে ভাগীরথী নদীর তীরে মাহেশ নামেতে এক গ্রাম আছে। সেখানে যাও। আমি সেখানে একটি বিরাট দারুব্রহ্ম (নিম গাছের কাণ্ড) পাঠিয়ে দেবো। সেই কাঠে বলরাম, সুভদ্রা আর আমার মূর্তি গড়ে পূজা করো। আমি তোমার হাতে ভোগ খাওয়ার জন্য উদগ্রীব।" এই স্বপ্ন দেখে ধ্রুবানন্দ মাহেশে এসে সাধনা শুরু করলেন। তারপর এক বর্ষার দিনে মাহেশ ঘাটে একটি নিমকাঠ ভেসে এল। তিনি জল থেকে সেই কাঠ তুলে তিন দেবতার মূর্তি বানিয়ে মন্দির প্রতিষ্ঠা করলেন।
পরবর্তীকালে ১৭৫৫-এ কলকাতার নয়নচাঁদ মল্লিক মাহেশে জগন্নাথ দেবের মন্দির তৈরি
করেছিলেন যা আজও রয়েছে। বর্তমান রথটি প্রায় ১৩৩ বছরের পুরনো। প্রতি বছর রথের আগে
বিগ্রহের অঙ্গরাগ হয়ে থাকে। রথের দিন জিটি রোড দিয়েই রথ টানা হয়। এই রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে
আজও বসে মেলা।
শ্রীরামপুরের জিটি রোড, ধরে ভায়া মাহেশফাঁড়ি, বোসপাড়া বাজার, মাসিরবাড়ি।কমলাকার
পিপলাই ছিলেন – শ্রীচৈতন্য দ্বাদশ গোপালদের মধ্যে পঞ্চম। তিনি সুন্দরবনে খালিঝুলি-র জমিদারের
পুত্র। তিনি যুক্তিবিজ্ঞান অধ্যয়ন করে নবদ্বীপের কাছে এলেন। পরে তিনি মহাপ্রভুর একটি প্রিয় শীষ্য
হয়ে ওঠেন এবং তার মন্ত্রণালয় যোগদান করেন। তিনি ৬৪ মহন্তের প্রথম। মাহেশ জগন্নাথ মন্দিরে
ভার গ্রহণ করার পর, তিনি থাকেন এবং তিনিই বিখ্যাত রথ উৎসব অধিক ৬২২ বছর আগে শুরু
করেন।তাঁর উত্তরাধিকারী্রা এখনো সেবাইত হিসেবে মাহেশে বসবাস করেন।
শুধু এই উৎসব প্রাচীনতম কিন্তু বাংলায় সর্ববৃহৎ রথযাত্রা হয়। প্রায় ২-৪ লাখ মানুষ মাসব্যাপী
মেলা দেখতে আসে। হুগলি জেলার শ্রীরামপুর ও রিষড়ার মাঝামাঝি জিটি রোডের ওপর মাহেশের
অবস্থান। গঙ্গার এ পারের শেওড়াফুলি, শ্রীরামপুর, রিষড়া, হিন্দমোটর এবং ও পারের টিটাগড়,
ব্যারাকপুর, খড়দহ, শ্যামনগর প্রভৃতি অঞ্চলের বাঙালিদের সঙ্গে অবাঙালিদের অংশগ্রহণ বিশেষ
উল্লেখযোগ্য।
রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, তার স্ত্রী মা সারদা দেবী, নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ, সাহিত্য সম্রাট
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ইত্যাদি অনেক মানুষ রথের বিখ্যাত মেলা পরিদর্শনে আসেন।
আধুনিক মন্দির ১৭৫৫ সালে নির্মাণ করা হয়। কলকাতা নিবাসী নয়নচাঁদ মল্লিক এর খরচ
দেন। সময়ের সঙ্গে সেই রথ জীর্ণ হয়ে পড়ে। কৃষ্ণরামের ছেলে গুরুপ্রসাদ ১৭৯৮ সালে নয় চূড়াবিশিষ্ট নতুন রথ বানিয়ে দেন। ১৮৮৪ সালে রথযাত্রার দিন বল্লভপুরে গুন্ডিচাবাটিতে সেই রথটি আগুনে পুড়ে যায়। তখন বসু পরিবারেরই কর্তা কৃষ্ণচন্দ্রবাবু বর্তমান লোহার রথটি তৈরি করিয়ে দেন। সেই সময়েই এর দাম পড়েছিল ২০ লক্ষ টাকা। ১৮৮৫ সাল থেকে ওই রথে টান শুরু হয়। সেই থেকে একভাবে ওই রথ চলছে।